তুষ্টি ভট্টাচার্য
ভ্রমণ
১)
টারবুলেন্স স্বাভাবিক এক প্রতিক্রিয়া
মেঘের ভেলায় ভাসা অত সোজাও নয় বন্ধু!
বন্ধুর সে পথে অচেনা সাথীকে হনুমান চালিশার আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
মৃত্যুভয় আর বুকের ভ্যাকুয়াম কখন যেন এক হয়ে গেল!
যাত্রার এরকমই দস্তুর যদিও…
২)
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শহরের অনুকূল ভাসিয়েছিলাম কাবেরীর তীরে
একাকিত্বের মতো নির্ভুল সংজ্ঞা আর নেই—একক চেয়ার শূন্য পড়ে থাক!
হাতীর বিশালাকার ভুলে তার নিষ্পাপ মুখ আর চোখের দিকে তাকিয়ে
কখন যেন রোদ পড়ে এলো
বৃহৎ আর অতিকায় দুই ভিন্ন শব্দের মাঝে বেড়ে ওঠা নির্জন এক টংঘরে
সন্তর্পনে মই বেয়ে ওঠার রোমাঞ্চ তখন আমাকে জড়িয়ে…
৩)
হাঁফ ধরে যাওয়া বয়স্ক দুই ফুসফুস আর বীতশ্রদ্ধ মন
বৃষ্টির দমকায় ফিল্টার কফির কড়া অনুশাসনে পুনর্বার বন্দি হল।
আরও একবার মুক্ত হতে চেয়ে
সবুজের কাছে, পাখিদের সমবেত কান ফাটানো চিৎকারে ভ্রূক্ষেপহীন থেকে যেতে চেয়ে
একটু একটু করে দীর্ঘ গাছেদের সারি এড়িয়ে আরও গভীরে চলেছি…
৪)
কফিবাগানে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে গাইড
বিজাতীয় হিন্দি ভাষণে হুড়মুড় করে বলে চলেছে সে
গাছেদের কথা, পাখিদের কথা আর কফি, মশলার কাহিনি…
দীর্ঘকায় চন্দন গাছের সারি আর গুল্মলতার নাম পানপাতা নয়,
গোলমরিচ! ওই দ্যাখো এলাচ, এই হল সিলভার ওক,
রোবাস্টা আর অ্যারোবিকার তফাৎ জেনে নাও এবার
আর দ্যাখো কফি প্রসেসিং, পান কর এক পেয়ালা তাজা সুবাস!
হাতে হাতে তৈরি তাজা চকোলেট নেবে না?
নেবে না মশলা, হাতের কাজ কোরাবার?
৫)
নিয়মিত ভাবে এক রাজা এসে বসতেন এখানে
সূর্যাস্তের রূপে মোহিত হতেন
উপত্যকার সবুজ প্রত্যক্ষ করে মহাদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম করতেন।
রাজা নেই, তাঁর সমাধি পড়ে আছে আজ
ভ্রমণপিপাসুদের উৎসুক দৃষ্টির মাঝে দর্শনীয় হয়ে রয়ে গেছে
সূর্যাস্ত আর পাহাড়, সমাধি আর উপত্যকা
৬)
আলো ফোটে
যদিও কুয়াশাস্নাত হয়ে ক্ষীণ সাদা চাদড়ে মুড়ে পড়ে থাকে মণ্ডলপট্টি
ধোঁয়ার আদলে মানুষের চেহারা মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম সেদিন খুব ভোরে
পশ্চিমঘাট পাহাড়ের সবটুকু খামোখা গিলে নিয়েছিল ওই রাক্ষুসে কুয়াশা
ক্ষিদে, ক্ষিদে…
একমাত্র সর্বগ্রাসী ক্ষিদের রূপ প্রকট হয়ে জেগেছিল।
৭)
আর পাখির কলরব
আর রোদের ঝলকে চকমক করে ওঠা রূপালী জলস্রোত
বর্ষায় গর্ভবতী হয়েছে সেই জলপ্রপাত
কান পেতে শুনেছিলাম তার ভ্রূণের চলন
ছিটকে ওঠা জলবিন্দু ভিজিয়ে দিয়েছিল মন
৮)
ফিরে আসা এক অলঙ্ঘ্য প্রক্রিয়া
খাদ্য আর খাদকের পরিবর্তিত অবস্থান থেকে
নিজেকে সরিয়ে ফেলা যায়?
সুস্বাদ, সুঘ্রাণ সম্বলিত জীবনযাত্রা ভেতরে ভেতরে
কোথাও কি ক্ষয়ে গেছে? অন্তর্নিহিত সেই রূপ যদিও দেখিনি
দেখা হয়নি প্রাণের পরশটুকু ছুঁয়ে
ঝকঝকে তকতকে কালিমাহীন সেই শহর রাতেও ঘুমোয় না
অথচ গভীর এক ঘুম আমার শিয়রে কড়া নাড়ছে
৯)
দুর্ভেদ্য অন্ধকার আকাশ চিরে বজ্রপাতের সাথেই ফিরে আসা
নিজের শহর আজ কেন যেন অচেনা লাগে
নিজের বলতে কার কতটুকু থাকে এই জীবনে
নিজের করে কতটুকু আর ভ্রমণে যেতে পারে মানুষ?
১০)
পাখির কলরব ছেড়ে আবার এসে পড়েছি
এই ধুলোর শহরে
কফিবাগান থেকে মশলার খুশবু আসে
পেসাই কফিবীজের সুগন্ধ নেই, জান তুমি?
জান কি, আমার মৃত শরীর শুধু পড়ে আছে
এখানে?
গুঁড়ি মেরে মনের অধিক কিছু
এলাচ গাছের পাশ কাটিয়ে
কফি পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে আছে।
সেও মৃতবৎ!
কত জন্ম গেলে আমাদের ব্যালেন্স শেখাবে, প্রভু?
Post a Comment