DEHLIJ

বারীন চক্রবর্তী

মুনাফার গন্ধ  

পূর্ণাঙ্গ নাটক, 



"প্রথম দৃশ্য"


(বাগানবাড়ির একটি অংশ! সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুহূর্তে আলোছায়ার মধ্যে  চতুর্দিকে বড় ছোট গাছপালার সমাহার দেখতে পাওয়া যায়! তারি মাঝখানে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি সুসজ্জিত টেবিল চেয়ার দিয়ে কিছুটা জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে! প্রত্যেকটি টেবিলের ওপর রঙিন হাল্কা আলো! পিছনে বাগানবাড়িতে আসা যাওয়ার জন্য কারুকার্য করা একটি সুদৃশ্য দরজা! বাগানবাড়ির সদর দরজা বলা যেতে পারে! দরজার মাথায় লাগান আছে একটি সিংহের হিংস্র কৃত্রিম মুখ! তার নিচে ঝোলানো আছে হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্টের একটি চিত্র! সেই দরজা থেকে একজন যুবক একটি ফ্লাওয়ার ভাস হাতে নিয়ে সোজা টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে! তার হাত দিয়ে 


ফ্লাওয়ার ভাস নির্দিষ্ট একটি টেবিলের ওপর রাখার পর সাজানগোছান সম্পূর্ণ হয় এবং সে মঞ্চের মাঝখানে এগিয়ে আসে!)


লালু: আমি এই বাগানবাড়ির দীর্ঘদিনের কেয়ারটেকার! ডাক নাম লালু! আধার কার্ডে অফিসিয়াল নাম, লালমোহন দলুই! বয়স তিরিশ! গ্র্যাজুয়েশন করার পর কোথাও কাজ না পেয়ে অবশেষে এই জায়গাটি হলো আমার কর্মক্ষেত্র! আমার কাজ এই বাগানবাড়িটিকে রক্ষণাবক্ষেণ করা এবং বসবাস করা! পরিবার বলতে আমার কেউ নেই! আমি অবিবাহিত! দেশের বাড়িতে মা বাবা আছেন! প্রতি মাসে নিজের রোজগার থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে ওনাদের হাতে তুলে দিয়ে আসি! আসলে আমার বন্ধুবান্ধব নেই বললেই চলে! এই যে গাছপালাগুলোকে দেখছেন, এরাই আমার প্রকৃত বন্ধু! আমার আদর ভালবাসা পেয়ে এরা বড় হয়ে উঠেছে! কেউ ফল দেয়, কেউ দেয় 


ফুল! এই ফলমূলগুলো বাগানবাড়ির মালিকের নির্দেশমত যতটুকু প্রয়োজন হয় আমি সেগুলো মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি! বাকিটুকু মালিককে না জানিয়ে জানাশোনা কিছু খদ্দেরদের হাতে তুলে দিয়ে উপরি রোজগার করে থাকি! অবশ্য মালিক যে এই ব্যাপারটা জানেন না, তা নয়! খুব ভালোভাবেই জানেন, এবং জানেন বলেই আমি সাহস করে দিনের পর দিন এই উপরি রোজগারে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি! কারণ এই বাগানবাড়িতে পা রাখার পর আমি বুঝতে পেরেছি, বাড়ির মালিক ডাঃ সন্তোষ সেন, ও হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো, উনি পেশায় একজন গাইনোকলজিস্ট, এই এলাকায় পাঁচ মাথার মোড়ে নিজের নার্সিং হোম আছে! উনি এবং ওনার পরিবার মুনাফার গন্ধ না পেলে কারো সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন না! দীর্ঘদিন এখানে থাকতে থাকতে, কাজ করতে করতে, সেই গন্ধ পাওয়ার নেশা আমার শরীরেও দানা বেঁধেছে! 

এবার আমি আসল কথায় আসি! যে কথা না বললে, আমার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! প্রতি 


সপ্তাহে, একদিন, অর্থাৎ প্রতি শনিবার, ঠিক সন্ধ্যাবেলায়, এখানে ডাক্তারবাবু নিজের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদের আসর জমান! প্রতি শনিবারের মত অতিথিরা যারা আজ এই মদের আসরে অংশগ্রহণ করবেন, তাদের মধ্যে সবাই এই শহরের একেকজন ধুরন্ধর প্রভাবশালী ব্যক্তি! ওনাদের আলোচনা চলাকালীন আপনারা বুঝতে পারবেন, কেন ওনারা এখানে প্রতি শনিবার আসেন এবং কি কারণে ওনারা আজ জমায়েত হয়েছেন!


(হঠাৎ গাড়ির শব্দ! লালু পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখে!)


লালু: ঐ যে, ডাক্তারবাবু এলেন! (ডাক্তারবাবুর উদ্দেশ্যে) যাই....!


(হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাসকে পিছনে রেখে ডাক্তার সন্তোষ সেন সরাসরি মঞ্চের মাঝখানে চলে আসে! মাথায় গল্ফ হ্যাট! লালুর হাতে ডাক্তার সন্তোষ সেনের ব্যাগ! নির্দিষ্ট 


জায়গায় ব্যাগটি রেখে সে দাঁড়িয়ে থাকে!)


সন্তোষ: (সন্দীপকে উদ্দেশ্য করে) হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস, আপনার দ্বারা কিস্সু হবে না! দূর মশাই, এতদিনে আপনি একটা গাড়ি কিনতে পারলেন না! মানুষের যত উন্নতি হচ্ছে, আপনার দিন দিন অবনতি হয়েই চলেছে! আরে বাবা, একটা পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড তো কিনতে পারতেন? তাহলে এই প্রতি শনিবার আপনাকে নিয়ে আসার ঝামেলা থাকত না!


সন্দীপ: আমাকে এখানে নিয়ে আসার জন্য আমি কখনও আবদার করিনি তো ডাক্তার সন্তাষ সেন! আমার এই পা দুটোই যথেষ্ট!


সন্তোষ: জানি জানি! ঐ পা দুটো নিয়ে প্রলেতারিয়েতদের সঙ্গে মিশে আপনি এখন তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছেন!


সন্দীপ: নেতৃত্ব দিতে না পারি, তবে ওদের সুখ 


দুঃখের সাথী হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকতে চাই! কিন্তু আজ এই মুহুর্তে আপনার মুখে প্রলেতারিয়েত শব্দটি কি আমার সাথে রসিকতা করার জন্য ব্যবহার করছেন? 


সন্তোষ: রসিকতা! (হাসতে হাসতে) তাহলে "সর্বহারা শ্রমজীবী" বলি?


সন্দীপ: আজকাল "সর্বহারা" এই শব্দটিকে নিয়েও আপনার মত অনেকেই রসিকতা করে থাকেন!


সন্তোষ: অর্থাৎ যারা রসিকতা করে, তাদের আপনি "শ্রেণীশত্রু" বলছেন?


সন্দীপ: সন্তোষবাবু, এই শহরে আপনার মত একজন প্রথিতযশা ডাক্তারকে কি "শ্রেণীশত্রু" এই সহজ বোধগম্য শব্দটির ব্যাখ্যা করতে হবে? 


সন্তোষ: তা হয়তো হবে না! তবে আপনি যে 


একটি পাকা মাল, বোঝার অবকাশ রাখি না! 


সন্দীপ: এতদিন ছিলাম কাঁচা মাল! আপনাদের সংস্পর্শে এসে কারবাইড ছাড়াই পেকে গায়ের রঙ পাল্টে গেছে মশাই!


সন্তোষ: (অট্টহাসি) তার মানে কাঁচা অবস্থায় থাকতেই আমরাই আপনাকে গাছ থেকে পেড়ে এনে পাকিয়েছি? বেড়ে বলেছেন তো মশাই! (হাসতে হাসতে লালুর দিকে চোখ যায়) এই, তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি শুনছিস রে! সবাই চলে এল বলে! যা নিজের কাজ কর!


(লালু নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! বাগানবাড়ির দরজার দিকে পা রাখে!)


সন্দীপ: আচ্ছা বলুন তো, আপনারা হঠাৎ  আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখাচ্ছেন কেন?


সন্তোষ: ভালো প্রশ্ন! দেখুন সন্দীপবাবু, শহরের কোথায় কোন সময়ে কি ঘটে চলেছে, সব 


আমাদের নখদর্পণে থাকে! আমরা জানি, এই শহরে একমাত্র আপনিই হলেন হোমিওপ্যাথিতে গোল্ড মেডেলিষ্ট! বিয়ে-থা করেননি! যে মেয়েটিকে আপনি  ভালবাসতেন, সে এখন আমেরিকার ফ্লোরিডায় থাকে! মেয়েটিও আপনার সাথে হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করেছে! পরস্পরকে ভালো লেগেছে! দুজনে কাছাকাছি এসেছেন! কিন্তু মেয়েটি যখন জানতে পারল, আপনি ঐ "সো-কলড" সর্বহারা শ্রমজীবীদের প্রতি বেশি চিন্তিত এবং আপনার আয়ের ভাঁড় শূন্য, নিজের ভবিষ্যত নিয়ে আপনি খুব একটা সিরিয়াস নন, তখন সে একজন ডেন্টাল সার্জনকে, ভালবেসে হোক, ফাঁসিয়ে হোক, আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পগারপার হলেন! মানে চিরদিনের জন্য একেবারেই ভোঁ হয়ে গেলেন! এই ঘটনা ঘটার পর আপনি রাগে হোক, দুঃখে হোক, অভিমান করে হোক,  আর বিয়ে করলেন না! বর্তমানে একমাত্র সন্তান হিসেবে বাবা মা-র রেখে যাওয়া পনেরো কাঠা জমির মালিক আপনি! সেই জমির এক কোনে রাস্তার ওপর আপনার 


ডিস্পেনসারি এবং সঙ্গে দুটো ঘর, যার একটাতে আপনি থাকেন! বাকি জায়গাটুকু আপনার বাবার লাগান বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য গাছপালা! এবার আমি আপনার প্রশ্নের উওর দেব! আপনি জিজ্ঞেস করছেন, কেন আপনার প্রতি আমাদের এত আগ্রহ! এই যে আপনার চিকিৎসা করার পদ্ধতি, যেখানে কোন মুনাফার গন্ধ নেই, শহরের নিম্নবর্গের মানুষেরা বা সর্বহারা মানুষেরা সরকারী হাসপাতাল থাকা সত্বেও আপনার কাছে আসে রোগ সারাতে এবং আপনি কখনও বিনামূল্যে বা কখনও যৎসামান্য টাকা পয়সা নিয়ে রোগ সারিয়ে তোলেন, তাতে আমাদের মনে হয়েছে আমরা আপনাকে আমাদের দলের সদস্য করে নিজেদের পাপের বোঝা কিছুটা লাঘব করব!


সন্দীপ: আপনি তো সাঙ্ঘাতিক মশাই! আপনি আমার ব্যাপারে সমস্ত নাড়ি নক্ষত্র যোগাড় করে রেখেছেন! তা আমাকে আপনাদের দলের সদস্য করলে আপনাদের পাপের বোঝা কতটা লাঘব হবে শুনি?



সন্তোষ: ও আপনি বুঝবেন না! প্রতি শনিবার এখানে আসুন, ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে!


সন্দীপ:আপনাদের দলের কি নাম রেখেছেন?


(কাউন্সিলর মদনমোহন মিশ্রর আগমন! তার পিছনে ট্রেতে করে কয়েকটি জল ভর্তি গ্লাস নিয়ে লালু টেবিলের ওপর রাখতে থাকে! )


মদনমোহন: (হাসতে হাসতে) মদ্যপান সমিতি! অলিখিত! নাম এখনও ঠিক হয়নি বলে আপাতত আমরা নিজেদের মধ্যে মদ্যপান সমিতির সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে থাকি! অবশ্য দলের এই নামের পরিচয়টুকু শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই গোপন থাকে! কারণ আমরা জানি, এই নামে আমরা কখনোই সরকারী স্বীকৃতি পাব না! সুতরাং সমিতি রেজিস্ট্রেশন করানোর কোন প্রশ্নই নেই!  আজ বোধহয় এই সমিতিতে আপনার দ্বিতীয়বার পদার্পণ?



(কথা শেষ করে মদনমোহন মিশ্র চেয়ারে বসে পড়লেন! জল ভর্তি গ্লাস মুখের সামনে তুলে ঢকঢক করে গলায় ঢালতে থাকলেন! অন্যদিকে আয়কর বিভাগের বড়বাবু লালকৃষ্ণ মাথুর ল্যাপটপ হাতে আগমন! পিছনে মহারানি জুয়েলার্সের মালিক সুনীল সামন্ত! হাতে হিসেবের লাল খাতা! গলায় সোনার মোটা চেন! লালকৃষ্ণবাবু টেবিলের ওপর ল্যাপটপ খুলে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন! অন্য আরেকটি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে সুনীল সামন্ত একটি লাল রঙের খাতা খুলে মনে মনে হিসেব কষতে থাকলেন!)


লালকৃষ্ণ: সন্দীপবাবু তো আবার মদ খান না! গত শনিবার কোল্ড ড্রিঙ্কসের সাথে আলুভাজা খেয়েছেন!


সুনীল: এই যে সন্দীপবাবু, নমস্কার! আমি সুনীল সামন্ত! চিনতে পারছেন তো? মহারানি জুয়েলার্স! মনে আছে?



লালকৃষ্ণ: (সুনীল সামন্তের প্রতি) এই শহরে আপনাকে কে চেনেনা বলুন তো? যেমন রাম কৃষ্ণ শিবের নাম নিলে মানুষের চোখের সামনে দেবতা হিসেবে তাদের রূপ ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনি মহারানি জুয়েলার্সের নাম শুনলেই এই শহরের প্রতিটি মানুষের চোখের সামনে আপনার মুখ ভেসে ওঠে! তিনজন হলেন দেবতা, আর আপনি হলেন ....!


সুনীল: কাঠিবাজি করছেন তো?


লালকৃষ্ণ: (জিভ কেটে) ছিঃ, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, আপনার সঙ্গে আমি করব কাঠিবাজি? আপনি ভাবলেন কি করে?


সন্তোষ: আজকের মেনু কি লালকৃষ্ণবাবু?


লালকৃষ্ণ: মেনু ল্যাপটপে তৈরি করা আছে! বাকিরা এলেই করিমের দোকানে মেইল করে দেব! 



সন্তোষ: (মোবাইল দেখে) সুদেষ্ণা  জহরবাবু ওনারা দেরি করছেন কেন? 


(বাইরে গাড়ির আওয়াজ!)


মদনমোহন: এই সময় রাস্তায় খুব জ্যাম হয়! বিশেষ করে আপনার ঐ পাঁচ মাথার মোড়ে!


সুনীল: আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন সন্দীপবাবু? বসুন! এরপর তো আপনার ঘোড়া রোগ হয়ে যাবে! আসুন, এখানে এসে বসুন!


(মদনমোহন মিশ্র পাশে রাখা চেয়ারে সন্দীপ বসে পড়ে! অন্যদিক থেকে গোবর্ধন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর কানুনগো এবং আসন্ন নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী সুদেষ্ণা বসুর প্রবেশ! )


জহর : নমস্কার! নমস্কার! নমস্কার! আচ্ছা আমাদের আসতে দেরি হয়ে গেল কি?



সন্তোষ: আপনি কোন দিন ঠিক সময়মতো পৌঁছেছেন?


জহর: সরি ভাই! যে কোন পার্টিতে হোক, বিয়েবাড়ি হোক, শ্রাদ্ধবাড়ি হোক, সেখানে দেরি করে পৌঁছালেও, গোবর্ধন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না, এই জহর কানুনগো স্কুলে কোন দিন দেরি করে পৌঁছেছে! কিন্তু আজ কেন দেরি হল, সেই ব্যাপারে তো কেউ প্রশ্ন করলেন না?


সুনীল: সংক্ষেপে বলুন!


সুদেষ্ণা: আমি বলছি! ঐ পাঁচ মাথার মোড়ে, ট্রাফিক সিগন্যালে, মানে ডাঃ সন্তোষ সেনের নার্সিং হোমের সামনে জ্যামে আমরা আটকে পড়েছিলাম! 


লালকৃষ্ণ: এই ব্যাপারে রাজ্যের মন্ত্রী এবং 


স্হানীয় এম এল এ-কে, এম পি'কে, চিঠি দিয়ে কাউন্সিলর মদনমোহনবাবুকে কপি টু করে পাঠিয়ে দিন! এসব জ্যাম-ট্যাম দুদিনে পরিষ্কার হয়ে যাবে! 


সুনীল: কাঁচকলা হবে! কাউন্সিলর মদনমোহনবাবুকে কপি টু করে কিস্সু হবে না! ওনার কথা কেউ শুনবেই না! রাজ্যের মন্ত্রী যা চাইবে তাই হবে! ঐ ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে দিনে কত টাকা আমদানি হয় জানেন? সেই টাকা আবার কতজনের মধ্যে ভাগ হয় জানেন?


জহর: দোকানপাটগুলো ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে! জ্যাম হবে না তো কি হবে? আর তাছাড়া কাউন্সিলর মদনমোহনবাবু রুলিং পার্টির সঙ্গে কতদিন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারবেন, আগে তাই দেখুন! কি মদনমোহনবাবু, ঠিক বলছি?


লালকৃষ্ণ: আপনি কি হর্স ট্রেডিং-এর গন্ধ পেয়েছেন?



সুনীল:( অট্টহাসি) মুনাফার গন্ধ! ঠিক বলেছি কিনা?


মদনমোহন: আপনারা এত খবর কোথায় পান বলুন তো? আমি পার্টি ছেড়ে কোন পার্টিতে যাব সেটা তো আমার ব্যাক্তিগত অধিকার!


সুদেষ্ণা: মদনমোহনবাবু, আসুন না একসাথে মিলে কাজ করি! আপনার মত একজন বিচক্ষণ ব্যাক্তিকে কাছে পেলে একজন নির্দলীয় ক্যান্ডিডেট হিসেবে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব!


সন্তোষ: বিধানসভা নির্বাচনের আর মাত্র ছ'মাস বাকি! এর মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে না পারলে ওরা ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে আপনাদের আবার সেই পাঁচ বছরের জন্য পাঁচ মাথার মোড়ে বসে মাছি তাড়াতে বলবে! কি হলো লালকৃষ্ণবাবু, আমাদের খাবারের মেনু কি করিমের দোকানে মেইল করেছেন?



লালকৃষ্ণ: চিন্তা করবেন না, ঠিক সময়মতো চলে আসবে! সবাই যখন এসে গেছেন, তাহলে লালুকে বলি ড্রিঙ্কস সাজাতে?


(সবাই এক সুরে হ্যাঁ হ্যাঁ করে ওঠেন!)


সন্তোষ: আজ মেনুতে কি কি আছে বললেন না তো?


লালকৃষ্ণ: (ল্যাপটপ দেখে দেখে) তাওয়া চিকেন, পনির টিক্কা, তন্দুরি চিকেনের লেগ পিস, ডাল মাখনি, রুমালি রুটি, পুদিনার চাটনি, স্যালাড! আর এখন ড্রিঙ্কসের সাথে থাকবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, হলদিরামের সল্টেড পি-নাট, হলদিরামের মুগডাল ভাজা! ওগুলো লালু সব এনে রেখে দিয়েছে! কেউ যদি ড্রিঙ্কসের সাথে স্যালাড পছন্দ করেন, লালু তার ব্যাবস্থা আগেই করে রেখেছে! খালি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইগুলো একটু গরম করে নিতে হবে!


(লালকৃষ্ণ মাথুর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান!)


লালকৃষ্ণ: এবার আমি আপনাদের অনুমতি নিয়ে একটু ঘুরে আসি? সাথে সাথে লালুকে তৈরি হতে বলি!


সন্তোষ: লালুকে বলবেন মিউজিক অন করতে! 


সুনীল: আপনি আবার কোথায় চললেন?


লালকৃষ্ণ: (কড়ে আঙুল দেখিয়ে!) ছোটঘরে!


সুনীল: এখানে আসার সময় একবার ঘুরে এলেন না? আবার?


লালকৃষ্ণ: লালু! লালু! কোথায় গেলি বাবা?


(লালকৃষ্ণ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ান! সেইসঙ্গে লালুর নাম ধরে ডাকতে থাকেন! লালু ভিতর থেকে মিউজিক অন করে! সেই মিউজিক সারা বাগানবাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে!)



জহর: লালকৃষ্ণবাবু হলেন আয়কর বিভাগের বড়বাবু! অডিট রিপোর্ট নিয়ে সারাদিন ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টগুলোতে ছুটে বেড়ান! বাইরে থেকে ওনার বাড়ি দেখেছেন? বাড়ির ভিতরে ঢুকেছেন কোনদিন? 


সুনীল: আহা:, অত ভ্যানতারা না করে খুলেই বলুন না?


জহর: শালা এক নম্বরের ঘুষখোর! যেমন বাপ ছিল, তার তেমন ছেলে হয়েছে! বয়স যত বাড়ছে, লোভ ততই বেড়েই চলেছে! দু'হাতে যে টাকা কামিয়েছে বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়!


সুনীল: (হাসতে হাসতে) তার মানে, যত ভোগ তত রোগ!


জহর: দাঁত কেলিয়ে হাসছেন? আপনি নিজে কি মশাই?


সুনীল: এবার কিন্তু আপনি পার্সোনাল এটাক করছেন!


জহর: আচ্ছা, যখন লালকৃষ্ণ মাথুরের ব্যাপারে বলছিলাম, তখন তো বেশ রসিয়ে উপভোগ করছিলেন!


সুনীল: এবার আমি বলি? আপনি হলেন গোবর্ধন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক! স্কুলে টিচার রিক্রুটমেন্টের সময় অসহায় মানুষের থেকে যে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়েছেন, সেই ব্যাপারে আমি কি আজ পর্যন্ত কোথাও মুখ খুলেছি?


জহর: কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে?


সুনীল: স্টিং অপারেশন! যারা আপনাকে বাড়িতে গিয়ে টেবিলের ওপর ঐ মোটা মোটা টাকার বান্ডিলগুলো রেখে এসেছিল, তারাই আমাকে বলেছে! ঠিক অনেকটা আপনার ঐ...!!



জহর: সারাদিন টিভিতে এম এল এ মন্ত্রীদের স্টিং অপারেশন দেখতে দেখতে আপনাদের মাথা একেবারে গেছে! আপনি হলেন এক নম্বরের গুলবাজ!


সন্তোষ: (দূর থেকে) এই যে সন্দীপবাবু, আপনি হার্ড নেবেন, না সফ্ট? কোনায় গিয়ে বসে আছেন কেন? এদিকে আসুন!


সন্দীপ: সফ্ট!


(লালু একটি নির্দিষ্ট টেবিলে স্কচ, হুইস্কির বোতল, গ্লাস রেখে এক এক করে বাকি সব জিনিস সাজাতে থাকে! ডাক্তার সন্তোষ সেন কিছু একটা চিন্তা করতে করতে সুদেষ্ণা ম্যাডামের কাছে এগিয়ে আসেন!)


সন্তোষ : (লালুকে নির্দেশ দিতে থাকেন!) লালু, প্রথমে সন্দীপবাবুর হাতে ওনার পছন্দমত 


ড্রিঙ্কস তুলে দাও! কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ, আচ্ছা সুদেষ্ণা ম্যাডাম, এই শহরের বিখ্যাত জায়গা হলো পাঁচ মাথার মোড়! কি না আছে সেখানে! শপিং মল থেকে শুরু করে দশকর্মা ভান্ডার! এমনকি আমার নার্সিং হোম! কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় সেখানে! ওখানে একটা ফ্লাই ওভার করলে এই যানজট থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে! তা আপনারা এই নিয়ে অন্যান্য দলগুলোকে নিয়ে এম এল এর থ্রু সরকারকে ডেপুটেশন দিলে ভালো হয় না? 


সুদেষ্ণা: আপনার প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করি সন্তোষবাবু! মদনমোহনবাবু আপনার কি মতামত?


(লালু এক গ্লাস সফ্ট ড্রিঙ্কস সন্দীপের হাতে তুলে দেয়!)


মদনমোহন: দলে থাকব কিনা ঠিক নেই,  আবার ডেপুটেশন!


সুদেষ্ণা: দল ছাড়ার আগে আপনি জনগনের জন্য কিছু একটা করুন! এই কাজটা কিভাবে জনগণকে এবং বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে এগোনো যায়, তাই নিয়ে ভাবুন!


সন্তোষ: মদনমোহনবাবু, আমার ইচ্ছে, এবারের নির্বাচনে আপনি সুদেষ্ণা ম্যাডামকে সহযোগিতা করবেন আশা করি!


মদনমোহন: একটু ভাবতে দিন মশাই! আর তা ছাড়া, দল তো আমি এখনও ছাড়িনি!


(লালু ট্রেতে হার্ড ড্রিঙ্কস সাজিয়ে পরিবেশন করতে থাকে! ট্রে থেকে সবাই যে যার গ্লাস তুলে নেয়! লালকৃষ্ণ মিশ্র বাত্রুম থেকে সোজা এসে লালুর হাতে ধরা ট্রে থেকে সাজান গ্লাসগুলোর মধ্যে থেকে একটি গ্লাস তুলে নেন!)


সুনীল: (কানে কানে) ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হাত ধুয়েছিলেন?


লালকৃষ্ণ: (জোর গলায়) না, ধুইনি! 


(লালকৃষ্ণর গলা শুনে সবাই সচকিত হয়ে ওঠে! হাত উঠিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বলে!)


লালকৃষ্ণ: সরি! ডোন্ট বি অ্যাফরেইড, ফ্রেইন্ডস! বি ইজি! 


সন্তোষ: ( সন্তোষবাবু ট্রে থেকে গ্লাস নিয়ে সুদেষ্ণা ম্যাডামের হাতে তুলে দেন! পরিবর্তে সুদেষ্ণা ম্যাডাম ডাক্তার সন্তোষ সেনকে "ধন্যবাদ" জানান! ডাক্তার সন্তোষ সেন তারপর নিজের গ্লাস তুলে নিয়ে মদনমোহন মিশ্রের কাঁধে হাত রেখে বলতে থাকেন!) হাতে কিন্তু আর সময় নেই! দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ডিসিশন নিয়ে নিন! যুদ্ধে নামার আগে নিজেকে প্রস্তুত করতে না পারলে নিধিরাম সর্দারের মত বিধানসভার নির্বাচনে নেমে আর কোন লাভ হবে না! সুতরাং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবার আগে আমার কথাগুলো একটু মনে রাখবেন! ও হ্যাঁ, আপনার বোনের এপিন্ডিক্স থেকে শুরু 


করে, এমনকি আপনার বাবার প্রস্টেট গ্ল্যান্ড অপারেশন, সব তো আমার নার্সিং হোমেই হয়েছিল! তখন তো আপনার আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না! তাই না?


মদনমোহন: আপনার অবদান কি ভোলা যায়! এখনও আমার বাবা আপনার নাম করেন! বলেন, ডাক্তার সন্তোষ সেন হলেন সাক্ষাৎ দেবতা!


সন্তোষ: এখন তো আপনার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হলো একমাত্র আপনার নিরাপত্তা, তাই না? ব্যাঙ্ক থেকে যা ইন্টারেস্ট পান, তাতে তো আপনি বহাল তবিয়তে জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন, তাই না? তাছাড়া ভবিষ্যতে কোনো পার্টির মুখাপেক্ষী হয়েও আপনাকে আর থাকতে হবে না! শুনলাম আপনার ভাই প্রমোটরের সাথে হাত মিলিয়ে কন্সট্রাকশন লাইনে ভালোই কাজ করছে! সেই কাজে নাকি আপনিও ইনভেস্ট করেছেন? এবার চোখ কান বুজে বিয়েটা করে ফেলুন!



( ডাক্তার সন্তোষ সেনের মোবাইল বেজে ওঠে!)


সন্তোষ: হ্যালো, কে বলছেন? আরে ডিসিপি অবিনাশ রাঠোর-জী যে! কি হলো আপনি এখনও এলেন না? আচ্ছা! আচ্ছা! কখন আসবেন বলতে পারছেন না! আজ আমরা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছি! আপনি থাকলে আপনার সাজেশনগুলো কাজে দিত, এই আর কি! কি বললেন,  কাল আসবেন? নার্সিং হোমে তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করব! অবশ্য যদি কোন অপারেশন না থাকে! সকালে না হয় আরেকবার ফোন করে নেবেন! (ফোন রেখে) নির্বাচনে এই ডিসিপি-কে কাজে লাগাতে হবে, মনে থাকে যেন! খুব সহজ সরল মানুষ! গত নির্বাচনের সময় রুলিং পার্টি গাধার মত খাটিয়েছে! কি না, ছাপ্পা ভোট দেওয়ার জন্য পাড়ার ছেলেদের সহযোগিতা করা! অস্বীকার করেছিলেন বলে অপমানিত হয়েছিলেন! প্রথম সারির একজন মন্ত্রীর হাতে থাপ্পড় খেয়েছিলেন!  এখন তার প্রতিশোধ 


তুলতে চান! হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম?


জহর: মদনমোহনবাবুর বিয়ে! 


(লালু ট্রেতে স্ন্যাকস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!)


সুদেষ্ণা! বিয়ে! একদম না! 


সন্তোষ: কেন? 


সুদেষ্ণা: আমাকে দেখুন! বিয়ে-থা না করে দিব্বি আছি! আমি জানি ডাক্তারবাবু, মদনমোহনবাবু বিয়ে-থা করে ঘরসংসার করলে উনি জনগনের জন্য আর সময় দিতে পারবেন না! ওনার ভিতরে এখনও যে স্পিরিট আছে, সেটা জনগনের জন্য, দেশের জন্য, সমর্পণ করা উচিত! আপনার গ্লাস তো খালি, মদনমোহনবাবু! (লালুকে চীৎকার করে ডেকে) লালু, মদনমোহনবাবুর জন্য আরেক পেগ নিয়ে এস ভাই! লার্জ! উইদ সোডা! মালের সাথে সোডা না মেশালে আমি আবার খেতেই পারিনা!



জহর: ম্যাডাম, মদনমোহনবাবুকে ছাড়বেন না কিন্তু! বয়সে আমাদের থেকে অনেক ছোট! তবে আপনার থেকে হয়তো কিছুটা বড়! পারলে আঁচলে বেঁধে রাখুন!


সুদেষ্ণা: আমি তো ওনাকে কতবার বলেছি, জীবনযুদ্ধে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বেন আমার ফ্ল্যাটে এসে বিশ্রাম নিতে পারেন! পছন্দমত সবকিছু পেয়ে যাবেন!


সুনীল: আর আমরা কি আঙুল চুষবো ম্যাডাম?


সুদেষ্ণা: আপনি খুব দুষ্টু! আপনার কাছে আমি যা আশা করি, তা কি আমি পাই?


সুনীল: আপনার কাছে আজ পর্যন্ত এমন কোনো আশা আকাঙ্খার কথা শুনিনি তো ম্যাডাম!


সুদেষ্ণা: ঐ যে, ইটালিয়ান ব্ল্যাক ডায়মন্ড 


নেকলেসটা! এত অনুরোধ করা সত্বেও কিছুতেই দাম কমালেন না!


সুনীল: কোনটা বলুন তো? 


সুদেষ্ণা: আরে বাবা, ঐ যে, ডায়মন্ডগুলো যার ওপর বসান আছে! কিছুতেই মনে করতে পারছি না!


সুনীল: সোনা দিয়ে তৈরি পান পাতার ওপর?


সুদেষ্ণা: ঠিক বলেছেন!


সুনীল: চলে আসুন আগামীকাল! 


সুদেষ্ণা: কখন?


সুনীল: সন্ধ্যার পর! যখন দোকানে কেউ থাকবে না! আর যদি দোকানে আসতে অসুবিধা হয়, আপনার বাড়িতে আমি নিজে পৌঁছে যাব! আপনার হাতে তৈরি এক কাপ চা 


খাব!


সুদেষ্ণা: চা কেন? আপনাকে আমি ফ্রান্সের ওয়াইন খাওয়াব! সঙ্গে থাকবে ফ্রায়েড রাইস, সাথে চিকেন সাসলিক!


সুনীল: সেটা আবার কি?


সুদেষ্ণা: জানার যখন শেষ নেই, জেনে আর লাভ নেই! যখন খাবেন তখন দেখবেন!


লালকৃষ্ণ: (সন্দীপকে দেখিয়ে) ম্যাডাম, এই গোবেচারা মানুষটাকে সঙ্গে করে আপনার বাড়িতে নিয়ে যান! তবে হ্যাঁ, উনি কিন্তু হার্ড ড্রিঙ্কস পছন্দ করেন না!


সুদেষ্ণা: (সন্দীপের দিকে এগিয়ে যায়!) কি কথা শুনছি ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস? আমি একজন মেয়েমানুষ হয়ে, এইসব প্রভাবশালী মানুষগুলোর সাথে বসে যদি সপ্তাহে একদিন দু-তিন ঘন্টার জন্য ফুর্তি করতে পারি, আপনি 


পারবেন না?


সন্দীপ: মদ খাওয়ার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই ম্যাডাম!


সুদেষ্ণা: আপনি কি ভাবছেন, আমরা রোজ খাই? ওনারা সবাই খান কিনা জানিনা, তবে আমি খাই না! (সন্দীপের কানের কাছে মুখ নিয়ে) চুপচাপ একবার খেয়ে নিন, আমার সম্মানটা অন্তত রাখার চেষ্টা করুন সন্দীপবাবু! লক্ষ্মীটি! সোনা আমার!


সন্দীপ: ঠিক আছে! তবে আবার কখনও ইনসিস্ট করবেন না!


সুদেষ্ণা: (লালুকে নির্দেশ দিলেন) গুড বয়! লালু, সন্দীপবাবুর জন্য ব্ল্যাক ডগ থেকে লার্জ পেগ! সঙ্গে সোডা!


(লালু গ্লাসে পেগ তৈরি করতে থাকে!)


জহর: মদ মদন মোহন! সব মিলেমিশে একাকার!


সন্তোষ: এই যে জহরবাবু, আপনারা এবার সিরিয়াসলি একটু মন দিয়ে শুনুন! সুদেষ্ণা যদি নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান, তাহলে এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে! তার আগে পাঁচমাথার মোড়ে ফ্লাই ওভার নিয়ে জনগনকে সাথে করে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে! এই এলাকায় ক্লাবগুলোর সাথে যোগাযোগ করুন! ওদের ডিম্যান্ডগুলো জানার চেষ্টা করুন! এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মদনমোহনবাবু আমাদের সাহায্য করতে পারবেন আশা করি! সুনীলবাবু আপনি এই এলাকায় যত ছোটবড় দোকান আছে তাদের সাথে এখন থেকেই সম্পর্ক গড়ে তুলুন!


সুনীল: পাঁচ মাথার মোড়ে কোন রাস্তা থেকে কোন রাস্তা পর্যন্ত ফ্লাই ওভার হবে সেটা তো আগে বলুন?


সন্তোষ: বি. সি. রয় রোড থেকে বি. বি. ব্যানার্জি রোড পর্যন্ত! 


লালকৃষ্ণ: মানে ফ্লাই ওভার শুরু হবে আপনার নার্সিং হোম থেকে সুনীলবাবুর মহারানি জুয়েলার্স পর্যন্ত!


মদনমোহন: ফ্লাই ওভার হলে তো মাঝখানে গোল জায়গায় জে.বোসের নামে যে গোল ফাউন্টেনের সাথে বড়ঘড়ির টাওয়ার আছে সেটা তো ভাঙতে হবে! বিরোধীরা আবার কোর্টে পিটিশন ফাইল না করে!


জহর: বিরোধীরা বলতে?


মদনমোহন: বিখ্যাত তিনজনের নাম শুনে বুঝতে পারছেন না, ওনারা কোন কোন দলের বিরোধী নেতা ছিলেন?


(লালু ট্রেতে করে গ্লাসে পেগ বানিয়ে, স্ন্যাকস নিয়ে, সন্দীপের টেবিলের সামনে দিয়ে আসে 


এবং নিজেদের মধ্যে কথোপকথন চলতে থাকে!)


সন্তোষ: এখন আমাদের কাজ হলো, আন্দোলনের সাথে সাথে ফান্ড যোগাড় করা!


সুনীল: নির্বাচনের লোগো কি হবে?


সন্তোষ: সে দায়িত্ব সুদেষ্ণা ম্যাডামকেই নিতে হবে!


সুদেষ্ণা: মাছ! মানে এই ধরুন, মাছ হলো বাঙালির প্রিয় খাবার! মাছের প্রতি অধিকাংশ বাঙালির দুর্বলতা আছে! আমি চাইব, এই আসন্ন নির্বাচনে মাছ হলো আমাদের ভবিষ্যত!


জহর: কোন মাছ? বাটা, পোনা, রুই, ভেটকি, কাতলা, পাবদা, পারসে, ইলিশ!


সন্তোষ: লোগোতে একটা সাধারণ মাছের ছবি থাকবে! পাশে থাকবে সুদেষ্ণা ম্যাডামের ছবি! 


সেই ছবি, শহরের দেওয়াল জুড়ে প্রচারের কাজে লাগান হবে! সব মাছ তো আর সবাই খায় না! যার যেরকম উপার্জন, সে সেই মাছ কিনে খায়! মাছ নিয়ে এই মুহুর্তে আমরা শ্রেণী বিভাজনে যেতে চাই না! এবার বলুন, আপনারা আর্থিক দিক থেকে কতটা কনট্রিবিউট করতে পারবেন? অবশ্য এই কনট্রিবিউশনের পিছনে আপনাদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না!


জহর: সুদেষ্ণা ম্যাডাম যদি হেরে যান?


সন্তোষ: সে দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দিন! দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি সুদেষ্ণা ম্যাডাম এই আসন্ন নির্বাচনে জিতবেন! জিতবেন! জিতবেন! 


মদনমোহন: জোর দিয়ে যখন বলছেন, তাহলে কিভাবে জিতবেন একটু খোলসা করুন?


সন্তোষ: এই লড়াইতে জেতার জন্য ষ্ট্যাট্রিজি কি কি হবে, আগামী সপ্তাহে আমি আপনাদের 


কাছে লিখিতভাবে নিয়ে আসব! আজ থেকে বিরোধী দলগুলোর কি কি দুর্বলতা আছে, তা নিয়ে আপনারা এক এক করে খবর সংগ্রহ করুন এবং আমাকে বলতে থাকুন!


লালকৃষ্ণ: নির্বাচনে মোটামুটি কত খরচ হবে আপনার মনে হয়?


সন্তোষ: তা প্রায় দুই- তিন!


জহর: মাত্র দুই-তিন লক্ষ?


সন্তোষ: দুই-তিন লক্ষ! Are you joking!কোটি মশাই কোটি! আপনারা সবাই মিলে দেড় দিন, বাকিটা আমি দিয়ে দেব!


সুনীল: টাকা কোথায় থাকবে?


সন্তোষ: ব্যাঙ্কে! যে কোন দলের একটা নাম দিয়ে কারেন্ট একাউন্ট খুলতে হবে! চেকে কে কে সিগনেচার করবে আগামী সপ্তাহে ঠিক করা 


হবে!


মদনমোহন: দলের রেজিস্ট্রেশন না থাকলে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার একাউন্ট খুলতে দেবে?


সন্তোষ: তিন কোটি টাকা মশাই! কোন ব্যাঙ্ক রাজি হবে না বলতে পারেন? তাছাড়া ব্যাঙ্কের ম্যানেজার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু! ওনার থ্রুতে বেশকিছু ব্যবসায়ীর থেকে টাকা যোগাড় করা যেতে পারে!


( ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস হাতে গ্লাস নিয়ে চেয়ার ছেড়ে হালকা চালে মঞ্চের মাঝখানে চলে আসে!)


সন্দীপ: আচ্ছা ডাক্তার সন্তোষ সেন, আপনি এই বাগানবাড়িতে ঢোকার মুখে  সদরদরজায় হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্ট ঝুলিয়ে রেখেছেন কেন?


সন্তোষ: Good question! হিউম্যান 


এনাটমিক্যাল চার্ট ঝুলিয়ে রেখেছি তাদের জন্য, যারা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন! আপনি মদ খেতে খেতে যতবার ঐ চার্টের দিকে তাকাবেন, আপনাদের মত শিক্ষিত মানুষদের বুঝতে অসুবিধা হবে না, অতিরিক্ত মদ খেলে শরীরের কোন কোন অরগ্যান ড্যামেজ হতে পারে! এই কথা ভাবতে ভাবতে আপনার টেনশন শুরু হবে এবং একবার টেনশন শুরু হলে আপনি অটোমেটিক্যালি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবেন! বিশেষজ্ঞরা কি বলেন জানেন? কেউ কেউ বলেন মদ খেলে উপকার হয়, আবার কেউ কেউ বলেন মদ খেলে শরীরের ক্ষতি হয়! যারা ক্ষতি হয় বলেন, আমি তাদের দলে!


সন্দীপ: কিন্তু আপনারা তো মদ ভালোই গিলতে পারেন দেখছি!


সন্তোষ: কে কে বাড়িতে কতটা খান আমি জানিনা! আমি আজকের দিনটাকেই বেশি পছন্দ করি! অর্থাৎ শনিবার! সারা সপ্তাহ 


গলদঘর্ম কাজ করে নিজেকে একটু রিলিফ দিতে চাই! অতিরিক্ত মদ্যপানে যদি হ্যাংওভার অথবা পেটের গন্ডগোল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, আগামীকাল হলো রবিবার, অর্থাৎ ছুটির দিন, আমি শুধুমাএ লেবুজল খেয়ে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে পারব! বাকী পাঁচদিন পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের প্রতি নজর দিতে পারব! গালিগালাজ শোনার আগেই, তাদের অভাব অভিযোগগুলো মন দিয়ে শোনার সময় পাব! মদ্যপানে নিজের কনট্রিবিউশনের কথা ভেবে উপরি রোজগারের জন্য নিজের কর্মক্ষেএে সারা সপ্তাহ আরো মনোনিবেশ করতে পারব! সব থেকে বড় ব্যাপার হলো, সারা সপ্তাহ, গভীর রাতে, নিজের বৌকে অতিরিক্ত আদর করতে পারব।


সুনীল: আবার বলুন! আবার বলুন!


সন্তোষ: কোনটা?


সুনীল: ঐ যে!



সন্তোষ: ঐ যে! কি?


সুনীল: ঐ যে, নিজের বৌকে অতিরিক্ত আদর করতে পারবেন!


সুদেষ্ণা: (ধমকে) সুনীলবাবু, ভুলে যাবেন না, আপনাদের সামনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন!


সুনীল: যাঃ বাবা, কথাটা তো ডাক্তার সন্তোষ সেন বললেন! আমার ওপর রাগ করছেন কেন? যত দোষ নন্দ ঘোষ!


সন্তোষ: সরি সুদেষ্ণা, আমার হয়তো তোমার সামনে এভাবে বলা উচিত হয়নি!  প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড!


সুদেষ্ণা: না না আমি কিছু মনে করছি না! আপনি চালিয়ে যেতে পারেন!



সন্দীপ: ডাক্তার সন্তোষ সেন, মদ খাওয়ার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই! তবে কলেজ জীবনে বা হোমিওপ্যাথি নিয়ে পড়াশোনা করার সময় বন্ধুবান্ধবদের পাল্লায় পড়ে একবার কি দুবার মদ আমিও যে খাইনি, তা আমি অস্বীকার করব না! তবে আমি দেখেছি, আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যে বেশি মদ খেয়েছে, অর্থাৎ যাদের মাত্রা বোধ কম, সে নিজেকে ধীরে ধীরে উলঙ্গ করে ফেলেছে!


জহর: আমাদের কথা ভাববেন না ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস! দেখবেন, মদ খেতে খেতে আপনি আবার নিজেই না উলঙ্গ হয়ে যান! মনে রাখবেন, আমরা যখন মদ খাই ঐ দরজায় লাগানো হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্টের দিকে নজর রাখি! 


সন্দীপ: কিন্তু ঐ হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্টের দিকে আমার যখন চোখ যায়, তখন কি মনে হয় জানেন? মনে হয়, ভারতবর্ষের অতীত 


বর্তমান ভবিষ্যত!


(লালকৃষ্ণ মাথুরের মোবাইল বেজে ওঠে!)


লালকৃষ্ণ: (মোবাইলে করিমের সাথে কথা বলছেন!) হ্যাঁ করিম, পাঠিয়ে দিয়েছ? সঙ্গে বিল? কত হয়েছে? ঠিক আছে! আমি বাগানবাড়ির বাইরে কাউকে পাঠাচ্ছি!


(মোবাইল বন্ধ করে লালুকে নির্দেশ দিলেন লালকৃষ্ণবাবু!)


লালকৃষ্ণ: লালু, খাবার চলে এসেছে! এক এক করে নিয়ে আয়! খাবারের সঙ্গে করিম বিল পাঠিয়েছে কিনা দেখে নিবি! (সবাইকে কড়ে আঙুল দেখিয়ে) আমি একটু আসছি!


সুনীল: আপনি আবার কোথায় চললেন?


(লালকৃষ্ণবাবু কড়ে আঙুল দেখিয়ে ওয়াশরুমের দিকে রওনা হলেন! সবাই হেসে 


ওঠে! মঞ্চ অন্ধকার হতে থাকে! শুধুমাত্র আলোর বৃত্ত সন্দীপবাবুকে ঘিরে ধরে! অন্ধকারে প্লেট এবং চামচের শব্দের যুগলবন্দি চলতে থাকে! প্রেক্ষাগৃহে মিউজিকের ভলিউম তীব্র হয়!)


"মুনাফার গন্ধ"  

পূর্ণাঙ্গ নাটক 

@বারীন চক্রবর্তী 


"দ্বিতীয় দৃশ্য"


(খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে!একেকজন নিজের নিজের জায়গায় বসে আছেন! হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস এক কোনে চেয়ারের ওপর বসে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে আছেন! লালকৃষ্ণ ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন! মদনমোহন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টুথপিক দিয়ে দাঁত খোচাচ্ছেন! জহর কানুনগো মোবাইলে ফেসবুক নিয়ে ব্যাস্ত! সুনীল সামন্ত নিজের লাল খাতায় হিসেব করছেন! সুদেষ্ণা বসু ব্যাগ খুলে 


আয়নায় নিজের মুখ দেখছেন! ডাক্তার সন্তোষ সেন এক কোনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছেন!)


সন্তোষ: বলুন অবিনাশ রাঠোর-জী? ঠিক আছে! তার মানে আপনি আমার নার্সিং হোমে সন্ধ্যার আগে আসতে পারবেন না? ঠিক আছে! আমি অপেক্ষা করব! আপনার জন্য খাওয়াদাওয়ার জন্য কিছু এরেঞ্জ করব কি? না বলছেন? ঠিক আছে! তবে হ্যাঁ, আসার আগে আসন্ন নির্বাচনে আমাদের মনোনীত প্রার্থী শ্রীমতি সুদেষ্ণা বসুর ব্যাপারে আপনার....বাষ্টার্ড!


(ডাক্তার সন্তোষ সেন বিরক্তি সহকারে মোবাইল বন্ধ করে সুদেষ্ণা বসুর কাছে এগিয়ে আসেন!)


সন্তোষ: হঠাৎ কি যে হয়! সিগন্যাল নেই! নাকি টাওয়ার কাজ করছ না, বোঝার উপায় নেই! এই যে সুদেষ্ণা ম্যাডাম, কাল সন্ধ্যায় আপনি কি একবার আমার নার্সিং হোমে আসতে 


পারবেন?


সুদেষ্ণা: কেন বলুন তো?


সন্তোষ: সন্ধ্যায় আমার নার্সিং হোমে ডিসিপি অবিনাশ রাঠোর আসছেন! ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না বাড়লে, উনি ইন্টারেস্ট কেন নেবেন বলুন?


সুদেষ্ণা: ঘনিষ্ঠতা বলতে?


সন্তোষ: আরে বাবা পাশে বসে দু পেগ মাল খাবেন! মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবেন! নির্বাচনে উনি কত কাজে আসবেন, আপনি জানেন? মনে রাখবেন, প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরে দুর্বলতা থাকে! সেগুলো অনেক সময় কাজে লাগাতে হয়! (কানের কাছে মুখ রেখে) আপনার পরবর্তী শিকার হলো হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস! মনে থাকে যেন!


(কেয়ারটেকার লালু দলুইকে আসতে দেখে 


সন্তোষবাবু থতমত খেয়ে মুখ সরিয়ে ফেলেন!)


লালু: স্যার, খাবার অনেক বেঁচে গেছে! কি করব?


সন্তোষ: কি আবার করবি, পাড়ার লালু ভুলুদের ডেকে দিয়ে দে!


লালু: ঠিক আছে স্যার!


(লালু ভিতরে চলে যায়!)


সুদেষ্ণা: আপনি কি কুকুর ভালবাসেন?


সন্তোষ: কেন বলুন তো?


সুদেষ্ণা: ঐ যে বললেন না, বাকি খাবারগুলো লালু ভুলুদের ডেকে দিয়ে দে!


সন্তোষ: (হাসতে হাসতে) আরে না না, লালু ভুলুরা হলো সব পাড়ার ছেলে! সামনের ঐ 


বস্তিতে থাকে! মাঝে মাঝে ওদের মদ মাংস না খাওয়ালে শরীরে জোর আসবে কি করে? নির্বাচনে ওদের কত প্রয়োজন! ( সুদেষ্ণার কানের কাছে মুখ এনে!) যান, এবার সন্দীপ বিশ্বাসকে কনফিডেন্সে নেওয়ার চেষ্টা করুন! আমি আপনাদের কাছে একটু পরে আসব! যাই বাগানে একটু ঘুরে আসি!


(মদনমোহন মিশ্র এগিয়ে আসেন!)


মদনমোহন: চলুন, আমিও আপনার সাথে যাব!


সন্তোষ: যাবেন? চলুন!


সুদেষ্ণা: এই অন্ধকারে বাগান দেখতে যাবেন? 


সন্তোষ: মোবাইলে টর্চ আছে!


সুদেষ্ণা: সাপ কামড়ে দেয় যদি!


সন্তোষ: কামড়ালে কামড়াবে! মনে রাখবেন, 


সাপের থেকে মানুষের বিষ আরো সাঙ্ঘাতিক!


সুদেষ্ণা: সাবধান!


( ডাক্তার সন্তোষ সেন এবং মদনমোহন মিশ্র মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে বাগানের দিক পা বাড়ালেন! সুদেষ্ণা ধীরে ধীরে সন্দীপের কাছে এগিয়ে যায়!)


সুদেষ্ণা: আকাশ দেখছেন?


সন্দীপ: ও: আপনি?


সুদেষ্ণা: বলছি, আকাশের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছেন?


সন্দীপ: আমার প্রিয় দুই কবির লেখা কিছু পংক্তি! 


সুদেষ্ণা: আপনার দুই প্রিয় কবির নাম জানতে পারি কি?



সন্দীপ: জীবনানন্দ দাস, শামসুর রাহমান!


সুদেষ্ণা: ওনাদের নাম জানি! কিন্তু আমার বোধবুদ্ধি অনুযায়ী ওনাদের কবিতা মগজে ঢোকে না! তবে কেউ কবিতা বললে, আমার শুনতে ভীষণ ভালো লাগে! একি! আপনার গ্লাস তো খালি! (লালুকে ডেকে) লালুভাই, আরেক পেগ ব্ল্যাক ডগ! লার্জ! উইদ সোডা! এবার বলুন, আমি শুনি!


সন্দীপ: কি?


সুদেষ্ণা: কবিতা! যে কবিতার পংক্তিগুলো,  এই মুহুর্তে আপনার মনে পড়ছে!


সন্দীপ: প্রথমে জীবনানন্দ! বলি?


সুদেষ্ণা: হ্যাঁ  হ্যাঁ বলুন?


সন্দীপ: "অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল;


মানুষকে স্থির—স্থিরতর হতে দেবে না সময়;

সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্তনদী।"


এরপর শামসুর রাহমানের তারায় তারায় কবিতার একটি পংক্তি-


"মানুষ আমি, আমার চোখে চোখ রেখে

যদি বলো, ‘তুমি একান্ত আমার’, কী করে থাকবো নির্বাক ?

তারায় তারায় রটিয়ে দেবো, ‘আমি তোমার, তুমি আমার’।"


সুদেষ্ণা: অসাধারণ! 


(সন্দীপের টেবিলে লালু গ্লাস রেখে যায়! সুনীল সামন্ত হিসেবের খাতা বন্ধ করে গ্লাস হাতে দরজায় ঝোলানো হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্টের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন! জহর কানুনগো গ্লাসে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে  নিজের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আছেন!)


সুদেষ্ণা: সন্দীপবাবু, এবার কাজের কথায় আসা যাক!


সন্দীপ: কাজের কথা!

 

সুদেষ্ণা: ডাক্তার সন্তোষ সেনের কাছে শুনলাম, আপনি নাকি এই শহরে শ্রমজীবী নিম্নবর্গের মানুষদের কাছে একজন ভগবান?


সন্দীপ: ভগবান! রিডিকিউলাস! এইসব কথা ডাক্তার সেন আপনাকে বলেছেন? 


সুদেষ্ণা: না মানে উনি বলতে চাইছেন, আপনার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করার পাশাপাশি, আপনি এই শহরের মধ্যে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কিনা বিনামূল্যে অথবা যৎসামান্য পয়সায় চিকিৎসা করার সাথে সাথে, ঐসব মানুষদের সুখদুঃখে পাশে দাঁড়ান!


সন্দীপ: সুখদুঃখে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ালেই বুঝি সে ভগবান হয়ে যায়? এইসব 


গ্যাস ডাক্তার সেন কেন যে দিয়ে থাকেন? চতুর্দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছেন না, মানুষ এখন মানুষের থেকে কত দূরে সরে গেছে ম্যাডাম? রক্তের সম্পর্ক, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখছে? দাঁত নখ বেরিয়ে আসছে! ভোগের তাড়নায় হিংস্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে! জাতের নামে, ধর্মের নামে ক্ষমতালোভী মানুষ পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে?


সুদেষ্ণা: সেইজন্যই তো আমি চাই আপনার মত একজন খোলা মনের মানুষ, যে মানুষটি আসন্ন নির্বাচনে আমার পাশে থাকবে! লক্ষীটি, প্লিজ, মানা করবেন না! হাত জোর করে অনুরোধ করছি!


সন্দীপ: আপনার পাশে আমি কিভাবে থাকব সেটা তো বলুন?


সুদেষ্ণা: নির্বাচনের আগে ঐ নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষদের কাছে আমার হয়ে প্রচার 


করবেন! তারপর ওরা যাতে আমার সাথে রাস্তায় নতুন ফ্লাই ওভার নিয়ে আন্দোলন করতে পারে, মিটিং, মিছিলে অংশগ্রহণ করতে পারে তার ব্যাবস্থা করবেন!


সন্দীপ: (হাত জোড় করে!) সরি ম্যাডাম! এই ব্যাপারে আমাকে জোর করবেন না প্লিজ! 


সুদেষ্ণা: কেন, জানতে পারি কি?


সন্দীপ: সে প্রশ্নের উওর আমি আপনাকে এই মুহুর্তে দিতে পারব না!


সুদেষ্ণা: কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলছেন?


সন্দীপ: কথা দিতে পারছি না!


(ডাক্তার সন্তোষ সেনের কাঁধে ভর দিয়ে মদনমোহন মিশ্র মঞ্চে প্রবেশ করলেন! মদনমোহন মিশ্র নেশায় চূড়! জামায় বমির দাগ! মাঝে মাঝে ওয়াক ওয়াক করছেন!)



সন্তোষ: লালু, ওনাকে ভেতরে নিয়ে যা! আর শোন, বিছানায় শোবার পর পাখা এসি চালিয়ে দিবি! স্যালাডে লেবুর টুকরো বেচে থাকলে, লেবুজল বানিয়ে খাইয়ে দিবি! আর মনে থাকে যেন, যাওয়ার সময় আমার গাড়িতে তুলে দিবি!


(লালুর কাঁধে ভর দিয়ে মদনমোহন মিশ্র ওয়াক ওয়াক করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়!)


সুনীল: উনি কি আজ দরজায় লাগানো আপনার হিউম্যান এনাটমিক্যাল চার্ট দেখেননি, ডাক্তার সেন? আমরাও তো খাচ্ছি, কই আমাদের তো কিছু হচ্ছে না!


সন্তোষ: আপনাদের বয়স, ওনার বয়স কি এক সুনীলবাবু? আপনারা তো মদের বোতল হাতে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন!


(সন্দীপের টেবিলের কাছে ডাক্তার সন্তোষ সেন 


এগিয়ে গেলেন!)


জহর: এই জন্য বলি,ভারতবর্ষের লোকেরা এখনও ধৈর্য্য ধরে মাল খাওয়া শিখল না! ইংরেজরা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে, কিন্তু মাল কি করে খেতে হয় তা শেখাতে পারে নি! পারবে কি করে ? আরে বাবা, মানুষের যেমন জাত আছে, মদও তেমনি বিভিন্ন জাতের! তালগাছের রস...মানে তাড়ি! চোলাই বা ধেনো, রাম, জিন, ফেনি, ভোদকা, হুইস্কি, ওয়াইন, একেকটি মদের একেক রকমের নেশা! পারলে নীট্ খা! গ্লাসে আইস্ কিউব ঢেলে খা! ফ্রিজের ঠান্ডা জল ঢেলে খা! সোডা মিশিয়ে খা! নাড়িয়ে নাড়িয়ে খা! দুলিয়ে দুলিয়ে খা! কিন্তু ...রয়ে-সয়ে খা! সময় নিয়ে খা! তা না, পেলি তো খেলি? একনিমেষে ঢক্ ঢক্ করে গিলে, নেশায় চূর হয়ে, মনের ইচ্ছাগুলোকে (কাম, ক্রোধ, লোভ) প্রকাশ করলি, সকলের সামনে নিজেকে ছোটো করে ফেললি, তারপর নিজের চরিত্রের বারোটা বাজিয়ে, জামায় বমি করে, ভাসিয়ে...ছ্যা ছ্যা 


ছ্যা!


(লালকৃষ্ণ মাথুর এবং সুনীল সামন্ত খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে ওঠেন!)


সন্তোষ: আহ্, এবার আপনারা একটু থামবেন? সরি টু সে, জহরবাবু, আপনার কথা শুনে মনে হয়না, আপনি একটি নামকরা স্কুলের প্রিন্সিপাল! 


(জহরবাবু থতমত খেয়ে গেলেন!)


জহর: সরি! সরি! সরি!


লালকৃষ্ণ: (ল্যাপটপ বন্ধ করে) আমি একটু আসছি!


সুনীল: আবার?


(লালকৃষ্ণবাবু বেরিয়ে যান!)


সন্তোষ: (সুদেষ্ণাকে) তোমাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়েছে?


সুদেষ্ণা: উনি কিছুদিন সময় চাইছেন! অ্যাম আই রাইট, সন্দীপবাবু?


সন্তোষ: ঠিক বুঝলাম না!


সুদেষ্ণা: মানে নির্বাচনের আগে উনি আমাকে সহযোগিতা করতে পারবেন কিনা, সেই ব্যপারে কথা দিতে পারছেন না!


সন্তোষ: কি শুনছি, সন্দীপবাবু? একজন অসহায় মহিলা আপনাকে অনুরোধ করছেন, সহযোগিতা করবার জন্য, আর আপনি ভাবার জন্য সময় চাইছেন? নির্বাচনের আর কতদিন বাকি আছে বলুন তো?


(সন্দীপ বিশ্বাসের নেশা ধীরে ধীরে চরম মাত্রায় পৌঁছচ্ছে!)


সন্দীপ: আপনি কি আমাকে এইজন্য এখানে নিয়ে এসেছেন? 


সন্তোষ: যদি বলি হ্যাঁ!


সন্দীপ: তাহলে আপনি ভুল জায়গায় হাত রেখেছেন ডাক্তার সেন!


সন্তোষ: ধরুন, আজ যদি আমি আপনার বড়ভাই হতাম, আপনি কি এইভাবে আমার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতেন?


সন্দীপ: বোধহয় হ্যাঁ!


সন্তোষ: কারণ জানতে পারি কি?


সন্দীপ: কারণগুলো আপনি ভালো করেই জানেন, ডাক্তার সেন!


সন্তোষ: না, আমি জানিনা! আমি আপনার মুখ থেকে আবার শুনতে চাই!



সন্দীপ: না, এখানে এখন বলার মত পরিস্থিতি নেই! অন্য আরেক দিন!


সন্তোষ: আচ্ছা সন্দীপবাবু, বাবা মা-র রেখে যাওয়া এখন কত কাঠা জমি আছে যেন আপনার? তা প্রায় পনেরো কাঠা! তাই না? আপনি যদি রাজি থাকেন, আপনার ঐ জমি কিনে নিতে মদনমোহনবাবুকে বলতে পারি! অবশ্য আপনি যদি রাজি থাকেন! এই শহরে কাঠা প্রতি জমির দাম কত জানেন? তা প্রায় সাত আঠ লক্ষ তো হবেই আশা করি!


সন্দীপ: আমি তো ঐ জমি বিক্রি করব না ডাক্তার সেন! ঐ জমির ওপর অন্য কিছু করার ভাবনাচিন্তা আছে আমার মাথায়!


সন্তোষ: কি করবেন, মাথায় করে স্বর্গে নিয়ে যাবেন? নাকি ঐ বস্তির সর্বহারাদের থাকার জায়গা করে যাবেন?



সন্দীপ: ভবিষ্যত সে কথা বলবে!


সন্তোষ: আপনার মত একগুঁয়ে বামপন্থীরা মচকাবে, তবু ভাঙবে না!


সন্দীপ: এইবার আপনি ঠিক কথা বলেছেন, ডাক্তার সেন! আমি নিজে বামপন্থী কিনা বলতে পারব না! আপনি জানেন কি বামপন্থী হতে গেলে জীবনচর্চা করতে হয়? মেরুদণ্ড সোজা রাখতে হয়?


সন্তোষ: বামপন্থী হতে গেলে কি হতে হয় না হয়, সেই ব্যাপারে আমার জানার এতটুকু আগ্রহ নেই! চোখ ঘুরিয়ে আজকের পৃথিবীটাকে দেখুন, ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে কমিউনিস্ট দেশগুলো কিভাবে আত্মসমর্পণ করছে!


সন্দীপ: আমার মনে হয় এবার যদি আমি আপনার সাথে তাত্বিক আলোচনা করি, তাহলে 


আপনাদের মুনাফা দিয়ে তৈরি এই কুত্সিত সাম্রাজ্যের রূপ উলঙ্গ হয়ে পড়বে!

তবে জেনে রাখুন, এই পৃথিবীতে অসংখ্য বামপন্থী এখনও আছেন, যাদের জন্য পৃথিবীটা এখনও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি, ডাক্তার সেন!


সন্তোষ: ঠিক আছে! কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই! এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! সন্দীপবাবু, আপনাকে আবার বলছি, ম্যাডাম সুদেষ্ণার প্রতি যদি আপনার এতটুকু সম্মান থাকে, তাহলে আপনি ওনাকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসবেন আশা করি!


(ওয়াশরুমে ফ্ল্যাশের আওয়াজ! লালকৃষ্ণবাবু কিছুক্ষণ পর মঞ্চের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন! পিছনে লালু!)


সুনীল: এই নিয়ে কতবার হলো?


জহর: টাকার পিছনে দৌড়চ্ছেন, নিজের শরীরের প্রতি একটু খেয়াল রাখুন!



সন্তোষ: লালু, আমার ব্যাগটা দে তো! তা হ্যাঁরে, মদনমোহনবাবু কেমন আছেন?


লালু: ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে হয়!


(লালু টেবিলের ওপর রাখা ব্যাগ ডাক্তার সন্তোষ সেনের হাতে তুলে দেয়! সন্তোষ সেন ব্যাগ খুলে প্রেসকিপসন বের করলেন!)


সন্তোষ:(লালকৃষ্ণবাবুকে) এখানে আসুন! বসুন এখানে!


(ডাক্তার সন্তোষ সেনের পাশে লালকৃষ্ণ মাথুর বসে পড়লেন!)


সন্তোষ:কতদিন সুগার টেস্ট করাননি?


লালকৃষ্ণ: গত সপ্তাহে করিয়েছিলেন, কিছুই বেরোয়নি!


সন্তোষ: (লিখতে লিখতে) কি কি টেস্ট করাতে হবে আমি লিখে দিচ্ছি! কাল রবিবার! বন্ধ থাকবে! পরশু ভোরবেলা কিছু না খেয়ে বাবা লোকনাথ ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে ব্লাড, ইউরিন দিয়ে আসবেন। ফাস্টিং পি পি দুটোই। সুগার টেষ্ট ছাড়াও সাথে সাথে এইচ বি এ ওয়ান সি, রাপিড প্রফাইল, কে এফ টি, এল এফ টি টেষ্টগুলোও করাবেন।


(ডাক্তার সন্তোষ সেনের হাত থেকে নিয়ে লালকৃষ্ণ মাথুর প্রেসকিপসন নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলেন!)


সন্তোষ: হ্যাঁ,  কি যেন বলছিলাম? ও হ্যাঁ,  আগামী শনিবার আসন্ন নির্বাচনে আমাদের ষ্ট্যাট্রিজি কি কি হবে এবং এজেন্ডা অনুযায়ী কি কি আলোচনা হবে, তার একটা খসড়া আমি করে নিয়ে আসব!


জহর: আর ঐ টাকপয়সার ব্যাপারটা?


সন্তোষ: বললাম তো, যা খরচ হবে তার অর্ধেকটা আমি দেব! ম্যাডাম সুদেষ্ণা, আপনি কিছু বলুন?


সুদেষ্ণা: আমি আর কি বলব! আপনারা সব বয়ঃজ্যেষ্ঠ! যা ভালো বুঝবেন, তাই করবেন!


জহর: না না না, আপনারও তো মতামত থাকতে পারে!


সন্তোষ: (সুদেষ্ণাকে) আপনি এক কাজ করুন, প্রথমে এই এলাকার প্রত্যেকটি ক্লাবের সেক্রেটারিদের সাথে যোগাযোগ করুন! সঙ্গে মদনমোহনবাবুকে বলব আপনার সাথে থাকতে! আরো কিছু ছেলে অবশ্য থাকবে! তবে ভুলে যাবেন না, সবকিছুই হবে সিক্রেটলি!


সুদেষ্ণা: কেন? সিক্রেটলি কেন?


সন্তোষ: এখন ওপেনলি না করাই ভালো! আমরা শুধু জনগনের টেম্পারেচার দেখব! মনে 


রাখবেন, আপনি একজন নির্দলীয় প্রার্থী! মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে জেতা যায় না! নির্দলীয় হয়ে যারা দাঁড়ায়, অন্যের কিছু ভোট হয়তো কাটতে পারে, তবে জেতার চান্স খুব কম থাকে!


সুনীল: আপনি তো মশাই একজন ক্যুইন মেকার! সুদেষ্ণা ম্যাডাম জিতবে না, এ কখনও হতে পারে!


(গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস চুপচাপ বসে আছেন! নেশায় নিজেকে সামলান কঠিন! তবুও ধৈর্য্য ধরে সবার কথা শুনছেন!)


জহর: কি হলো ডাক্তার সন্দীপ বিশ্বাস,  আপনি তো মাল খেয়ে পাথর হয়ে গেলেন! কিছু বলুন?


সন্দীপ: ভাবছি... দেবাশিষবাবুর গু, মুত, রক্ত পরীক্ষা হওয়ার পর, বাবা লোকনাথ ডায়াগনষ্টীক সেন্টার থেকে, সুকুমারবাবু কত কমিশন পাবেন?



সন্তোষ: কি বললেন, আরেকবার বলুন?


সন্দীপ: আপনি কি কালা? কানে কম শোনেন? আমি যা বলেছি, সবাই শুনতে পেল, আপনার কানেই ঢুকল না?


সন্তোষ: শালা তোর সাহস তো কম না! আমার পয়সায় মাল খাবি, আবার আমার বুকের উপর বসে লোম ছিঁড়বি? শালা শুয়োরের বাচ্চা!


সন্দীপ: খিস্তি খেউড় একদম করবেন না! পিছনে হুড়কো দিয়ে দেব! সে ক্ষমতা আমারও আছে, ডাক্তার সেন! 


(ডাক্তার সন্তোষ সেন চেয়ার ছেড়ে সন্দীপের কাছে এগিয়ে যান!)


সন্তোষ: দ্যাখা দেখি তোর কত ক্ষমতা, দ্যাখা দেখি! দুপয়সার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, তার আবার এত ফুটানি!  এ্যালোপাথি ডাক্তার 


সুকুমার সেন ডাইআগনোস করে ওষুধ লেখে রে হতভাগা! তোর মত চিনির পাউডার, চিনির গুলি খাইয়ে লোক ঠকায় না রে শালা ! (নিজের জায়গায় ফিরে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন!) এই জানোয়ারের সাথে আমি এখানে এক দন্ড দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না! আমি চললাম!


লালকৃষ্ণ: আহা, অত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ওনার মাল খাওয়ার অভ্যাস নেই, দু-পেগ লার্জ খেয়ে ফেলেছেন, গন্ডগোল তো একটু হবেই!


(চীৎকার শুনে মদনমোহন মিশ্র বিছানা ছেড়ে উঠে চলে এলেন!)


মদনমোহন: কি হয়েছে, এত চীৎকার চেঁচামেচি কেন?


সন্তোষ: আপনি কি আমার সাথে যাবেন? আমি এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাব! 


মদনমোহন: আহা, কি হয়েছে বলবেন তো?


সন্তোষ: আগে গাড়িতে উঠুন, তারপর বলছি!


সুদেষ্ণা: আমিও এখানে আর থাকতে চাই না! যত্তসব হুজ্জুতি! 


সন্তোষ: চলুন আমার সঙ্গে! লালু, ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দে!


(ডাক্তার সেন, মদনমোহন, সুদেষ্ণা দরজা দিয়ে বাইরে পা রাখলেন! পিছনে ব্যাগ নিয়ে লালু অনুসরণ করল!) 


জহর: আমরাও চলি, কি বল সুনীল?


সুনীল: এখানে থেকে আর কি করব? বগল বাজাব? মাল খেতে এসে এরকম কেচ্ছা হলে কি আর নেশা থাকে? চলুন!


(জহরবাবু এবং সুনীলবাবু দরজা দিয়ে বাইরে 


পা রাখলেন! লালকৃষ্ণবাবু টেবিল ছেড়ে সন্দীপবাবুর কাছে এসে দাঁড়ালেন!)


লালকৃষ্ণ: যখন সহ্য করতে পারেন না, খান কেন?


সন্দীপ: জ্ঞ্যান দেবেন না...জ্ঞ্যান দেবেন না মশাই! গত শনিবার আপনারা দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন না? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আপনি ঘুষ খান না? আপনাদের ঐ ডাক্তার সন্তোষ সেন, ঠান্ডা লেগে গেলে, সামান্য জ্বর হলে, দু'দিন পর পর চেম্বারে আসতে বলবে কেন বলুন তো? ওনার চেনাজানা দোকান থেকে ওষুধ কিনতে বলবে কেন বলুন তো? ওষুধ কোম্পানির পয়সায় ব্যাংকক সিঙ্গাপুর, গোয়া, মালদ্বীপ ঘুরতে যায় কেন বলুন তো? প্রয়োজন না হলেও, এম আর আই, আলট্রা-সাউন্ড, ইসিজি, পায়খানা, পেচ্ছাব, রক্ত পরীক্ষা করতে ডায়াগনষ্টীক সেন্টারে পাঠায় কেন বলুন  তো? কারন কি জানেন? ভালো কমিশন পাওয়া যায়! কমিশন মশাই কমিশন! 


ওরে বাবা, সঙ্গে আবার গিফ্ট থাকে! নির্লজ্জের মত সেই গিফ্ট পরিবারের জন্য হ্যাংলাদের মত চাইতে থাকে!

এই শহরের বেসরকারী হাসপাতালগুলো হয়েছে আরেক, সরকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সুপার স্পেশালিটি, মাল্টি স্পশালিটির নামে যা ইচ্ছে তাই করছে? মাফিয়াচক্রদের আবার গালভরা যতসব নাম! সেই হাসপাতালে ভিজিট করছেন কে? না... আপনাদের ঐ আদরের দুলাল ডাক্তার সন্তোষ সেন! সেই হাসপাতালে গরীব নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী  মানুষগুলো দিনের পর দিন সুপার প্রফিট আর্নিং মেকানিজমের শিকার হচ্ছে!


লালকৃষ্ণ: চলুন! আপনাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি!


সন্দীপ: আরে দাঁড়ান না মশাই! সব কথা শুনে যান! আপনাদের ঐ ধেড়ে কাউন্সিলার মদনমোহন মিশ্র, সারাদিন পার্টি অফিসে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে সিন্ডিকেট রাজ চালাচ্ছে! 


রাএিবেলা পার্টি অফিসের ঝাঁপ ফেলে বেপাড়ার কচি কচি মেয়েদের নিয়ে ফূর্তি করছে! রাজ্যে পার্টি বদলে গেলে এরাও রং বদলে ফেলে! শালিশি সভা ডেকে মধ্যবিও পরিবারের ঝুটঝামেলা মেটাতে গিয়ে ভাতের হাঁড়িতে মুখ ঢুকিয়ে প্রাইভেসি জানার চেষ্টা করবে ! শালা! 


লালকৃষ্ণ: সন্দীপবাবু, রাত হয়ে গেছে! চলুন!


সন্দীপ:আর আপনাদের ঐ হেডমাষ্টার জহর কানুনগো, টিচার রিক্রটমেন্টের সময় লাখ লাখ টাকা ঘুষ খাচ্ছে। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে  আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে দিদিমনিদের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে। 


লালকৃষ্ণ: আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো! এইসব কথা আমাকে শুনিয়ে কি লাভ? বাড়ি যাবেন কিনা বলুন?


সন্দীপ: আপনাদের মহারানি জুয়েলার্সের 


মালিক সুনীল সামন্ত, সোনার মধ্যে তামা রুপো মিশিয়ে নিজের পাড়ার জানাশোনা লোকদের পর্যন্ত ঠকাচ্ছে। তারাই আবার দুর্নীতি নিয়ে লেকচার দিচ্ছিল? দুর্নীতি মারাচ্ছে শালা? ম্যাডাম সুদেষ্ণার ব্যাপারে শুনতে চান? না ওনার ব্যাপারে আমি কিছু বলব না! কারণ উনি একজন মহিলা, এই কথাটা যেন সবার মনে থাকে!


(হঠাৎ লালকৃষ্ণবাবুর মোবাইল বেজে ওঠে!)


লালকৃষ্ণ: সর্বনাশ...ননিগোপালবাবু! সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। এবার আপনার বৌমা ধরে আমাকে ঠ্যাঙাবে! আমি চললাম। 


সন্দীপ: চলে যাবেন? যান তাহলে!


(লালকৃষ্ণবাবু নিজের ল্যাপটপ নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যান! লালু সেই সময় মঞ্চের মাঝখানে চলে আসে!)


সন্দীপ: (চীৎকার করে) এই যে শুনছেন, পারলে আমার ডিসপেনসারিতে আসবেন। আপনার বহুমূএরোগ হয়েছে কিনা বলে দেব। পয়সা দিতে হবে না। আরে মশাই, জেলে পাড়া , বাগ্দি পাড়া, কুমোর পাড়ার  মানুষগুলো, যারা দু-মুঠো ভালো করে খাবার পায় না, আমি ওদের কথা ভেবে ঘুষখোর হতে পারি নি। শুনে রাখুন, মুনাফার গন্ধে নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষদের কথা আমি ভুলে যেতে পারি না! পারব না! মরলে পর ওরাই আমাকে শ্বশানে নিয়ে মুখাগ্নি করবে রে শালা !


(নেশার ঘোরে সন্তোষবাবু ক্লান্ত হয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চেয়ারে বসে পড়েন! লালু ধীরে ধীরে সন্দীপবাবুর কাছে এগিয়ে আসে!)


লালু: স্যার!


সন্দীপ: কে?


লালু: আমি!



সন্দীপ: আমি কে?


লালু: লালু! 


সন্দীপ: পুরো নামটা বল ভাই?


লালু: লালমোহন দলুই! চলুন আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি!


সন্দীপ: ও তুমি দলুই? লালমোহন দলুই? আমার বাড়ির পিছনে বস্তিতে থাকে ব্রজেশ্বর দলুই, মাহাতো, মালাকার, গুঁই, ওদের চেন? বল না ভাই, তুমি ওদের চেন কিনা? বল না? বল না ভাই .....!!!


(নেশায় কথা ক্ষীণ হয়ে আসে! লালমোহন দলুই-এর দিকে সন্দীপ বিশ্বাস কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন! নিজের হাতটা লালমোহন দলুই-এর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন! মঞ্চ 


অন্ধকার হয়ে আসে!)

**************************************

সমাপ্ত সমাপ্ত সমাপ্ত সমাপ্ত সমাপ্ত সমাপ্ত 


সতর্কীকরণ: আমার লেখা বাংলায় এই নাটকটির প্রাথমিক খসড়া!  হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করার কাজ চলছে! কোনো দলের মঞ্চস্থ করার ইচ্ছে থাকলে শর্তের ভিত্তিতে লিখিতভাবে নাট্যকারের অনুমতি নেওয়া আইনগত দিক থেকে অতি আবশ্যক! অন্যায়ভাবে নাট্যকারকে না জানিয়ে এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছায় নাটকের মূল পাণ্ডুলিপির রদবদল করা হলে তা আইনগতভাবে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে!


(All rights reserved. No part of the publication may be reproduced, stored in a retrieval system, or transmitted in any form, or by any means, electronic, mechanical, photocopying, stage performance, recording or otherwise, without the prior permission of the Playwright/publisher.)


No comments

FACEBOOK COMMENT